স্বাপ্নিক দূরদৃষ্টি, অদম্য একাগ্রতা ও গতিশীলতা নিয়ে স্যার ফজলে হাসান আবেদ

News Editor 2023-12-05 বরেণ্য ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব View 1108

স্বাপ্নিক দূরদৃষ্টি, অদম্য একাগ্রতা ও গতিশীলতাধারন করে কোটি দরিদ্র মানুষের কষ্ট লাঘবে অক্লান্তভাবে কাজ করেছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৭০ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণীঝড়ে আক্রান্ত মানুষের দুর্দশা দেখে কিছু করার প্রয়াসে ত্রানকাজে ফজলে হাসান আবেদ নিজেকে নিয়োজিত করেন। এরপর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হাজার শরনার্থীদের সাহায্য করার জন্য তিনি লন্ডনে তার বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে দেশে আসেন সেইসব বিপন্ন মানুষের মধ্যে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের পরিচালনা করার জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৭২ সালে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের এপ্রিল মাসে হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে জন্মগ্রহণ করেন।  তার  পিতা সিদ্দিক হাসান একজন জমিদার ছিলেন এবং পরিবারের সবাই ছিলেন শিক্ষিত।  তার বাবা অসুস্থ্য হয়ে গেলে তিনি চাচার কর্মস্থল কুমিল্লায় জেলা স্কুলে ভর্তি হন। পরবর্তিতে তার চাচা বদলি হন পাবনায় এবং পাবনা জেলা স্কুল থেকে ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। 

ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৪ সালে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিভাগে সম্মানে ভর্তি হন ফজলে হাসান আবেদ। ১৯৫৬ সালের স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হন।  কিন্তু তিনি দেখলেন যে পূর্ব পাকিস্তানে জাহাজ শিল্পে কাজ করার কোন সুযোগ নেই। তাই তিনি কোর্স অসমাপ্ত রেখে ১৯৫৬ সালে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে ভর্তি হন অ্যাকাউন্টিংয়ে। সেখানে কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিংয়ে প্রফেশনাল কোর্স সম্পন্ন করেন ১৯৬২ সালে। এর পর তিনি দেশে ফিরে এসে শেল অয়েল কোম্পানিতে ফাইনান্স বিভাগে চাকরীতে যোগ দেন।

১৯৭০ সালে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব উপকুলে ভয়াবহ ঘুর্ণীঝড় আঘাত আনে যাতে প্রায় তিন লক্ষ মানুষ মারা যায় এবং বহু ক্ষয়-ক্ষতি হয়। হাজার হাজার বিপন্ন মানুষের কষ্ট স্যার ফজলে হাসান আবেদের জীবনদর্শনে গভীর প্রভাব ফেলে। সে সময় তিনি তার বন্ধুদের নিয়ে মনপুরায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থদের ত্রান ও পুনর্বাসন করা লক্ষ্য নিয়ে HELP নামে একটি সংগঠন তৈরী করেন। কিন্তু ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি দেশ ছেড়ে ইংল্যান্ডে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। তবে দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা তখনও অটুট ছিল। সেখানে তিনি ইউরোপে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন আদায় করার জন্য Action Bangladesh নামে একটি লবিং গ্রুপ তৈরী করেন। লন্ডনে তার একটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেন এবং  সেই অর্থ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালে সিলেটের কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিনি ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেন। দরিদ্র, অসহায় মানুষের ত্রাণ ও পুনর্বাসনকল্পে শুরু করলেন 'Bangladesh Rehabilitation Assistance Committee' সংক্ষেপে যা 'BRAC' বা ব্র্যাক নামে একটি সংগঠন তৈরী করে। ১৯৭৩ সালে ব্রাক উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে কাজ শুরু করে, তখন 'BRAC শব্দসংক্ষেপটির যে ব্যাখ্যা গ্রহণ করা সেটা হলো  'Bangladesh Rural Advancement Committee' ।  ১৯৭২ সালে ব্র্যাকের গভর্নিং বোর্ড গঠিত হয় যার প্রথম চেয়ারপারসন ছিলেন কবি বেগম সুফিয়া কামাল। 

স্যার ফজলে হাসান আবেদ বাংলাদেশে ক্ষুধা ও দারিদ্র দুরীকরনে, নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে নিরলসভাবে কাজ করেছেন

তিনি তার মত ও সপ্নকে শুধুমাত্র দেশে মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি

 তিনি বিশ্বাস করতেন দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দরিদ্রদের কাছে তাদের সব ক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে হবে

স্যার ফজলে হাসান আবেদ বাংলাদেশে ক্ষুধা ও দারিদ্র দুরীকরনে, নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। তিনি তার মত ও সপ্নকে শুধুমাত্র দেশে মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি। তিনি তার মানব সেবা ব্র্যাকের মাধ্যমে সারা বিশ্বে নিরলসভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক বিশ্বের ১০টির বেশি দেশে শিক্ষা, সাস্থ্য, দরিদ্র ও নীপিড়িত মানুষের ক্ষমতায়ন ও  উন্নয়নের জন্য কাজ করে চলেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দরিদ্রদের কাছে তাদের সব ক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে হবে।  মানবাধিকার এবং সামাজিক ক্ষমতায়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতা এবং দুর্যোগ প্রস্তুতির উন্নয়ন করা জরুরী।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভ্ন্নি পুরস্কার ও সম্মননা পেয়েছেন।  ১৯৮০ সালে ২য় বাংলাদেশী হিসেবে তিনি র‌্যামন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড ফর কমিউনিটি লিডারশিপ লাভ করেন। ২০১৬ সালে স্যার ফজলে হাসান আবেদ  'টমাস ফ্রান্সিস জুনিয়র মেডেল অব গ্লোবাল পাবলিক হেলথ' পদক পান। দরিদ্র মানুষের সুরক্ষায় কাজ করার জন্য ও বিশ্ব জনস্বাস্থ্য বিষয়ে অবদান রাখার জন্য এ সম্মান দেয়া হয়। দারিদ্র বিমোচনে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য ব্রিটেন  ২০০৯ সালে  স্যার ফজলে হাসান আবেদ "নাইটহুডে" ভূষিত করে। ২০১৫ সালে  তিনি বাংলাদেশ সহ বিশ্বের ১০টি দেশে দারিদ্রতা দুরীকরনে অসাধারন অবদান রাখার জন্য ‘বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার’ লাভ করেন।  এছাড়া তিনি বিভিন্ন সম্মানসূচক  ডিগ্রি পেয়েছেন যাদের মধ্যে ২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ডক্টরেট অব লেটার্স,২০০৮ সালে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব ল এবং ২০০৭ সালে ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট অব হিউম্যান লেটারস, ২০১২ সালে  ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি, ২০১০ সালে বাথ ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ  এবং  কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৯৪ সালে ডক্টর অব লজ উল্লেখযোগ্য।

২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।


সাম্প্রতিক